সুনামগঞ্জ , মঙ্গলবার, ২৮ অক্টোবর ২০২৫ , ১৩ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
ধোপাজানে অবৈধভাবে ১৪ দিনে ২৪ কোটি টাকার সিলিকা বালু লুট জুলাই আন্দোলনের পর সবচেয়ে বেশি সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন আমলারা : হাসনাত আবদুল্লাহ সড়ক দুর্ঘটনা রোধে পদক্ষেপ গ্রহণের দাবিতে মানববন্ধন ধর্মপাশায় সড়ক পুনঃনির্মাণের দাবিতে অবরোধ যুবদলের ৪৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপিত গণভোটে কী হবে? কলেজে টিকটক-লাইকির ভিডিও ধারণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বিজ্ঞপ্তি সুনামগঞ্জে শব্দদূষণ বিরোধী অভিযান: ৫ যানবাহনকে জরিমানা, জব্দ ৭ হাইড্রোলিক হর্ণ দোয়ারাবাজারে স্কুলছাত্রীকে হত্যার চেষ্টা, বখাটের শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন ৭০ হাজার টাকা দিয়ে মীমাংসার চেষ্টা, প্রতিবন্ধী কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা দায়ের ১০ লাখ টাকার চেক ফেরত দিয়েছি, কর্মীর ভালোবাসা গ্রহণ করেছি : কামরুজ্জামান কামরুল শহরে অনুমোদনবিহীন পোস্টার-ব্যানার অপসারণের নির্দেশ ধোপাজান খুবলে খাচ্ছে ‘লিমপিড ইঞ্জিনিয়ারিং’ সেতুর অভাবে ভোগান্তিতে ৫ লাখ মানুষ নির্বাচনে সব দলকে অংশ নেয়ার আহ্বান বিএনপি মহাসচিবের দরিদ্র মানুষের বিচারপ্রাপ্তির আশ্রয়স্থল গ্রাম আদালত : অতিরিক্ত সচিব সুরাইয়া আক্তার জাহান যারা পিআর পদ্ধতির দাবি করে, তারা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী নয় : কলিম উদ্দিন আহমেদ মিলন প্রাচীন বাংলার হাবেলি দুর্গ ও রাজবাড়ি দখল হচ্ছে প্রতিদিন ফুটপাতে ‘উচ্ছেদ-দখল’ খেলা ‘মর্যাদাপূর্ণ’ সিলেট-১ আসনে কার হাতে উঠবে ধানের শীষ?

গণভোটে কী হবে?

  • আপলোড সময় : ২৮-১০-২০২৫ ০৭:৫৯:৩৯ পূর্বাহ্ন
  • আপডেট সময় : ২৮-১০-২০২৫ ০৭:৫৯:৩৯ পূর্বাহ্ন
গণভোটে কী হবে?
আমীন আল রশীদ:: জুলাই সনদ বাস্তবায়ন এবং তার আলোকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য নভেম্বরে গণভোটের দাবি জামায়াতের। গত ২২ অক্টোবর সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের পর প্রেস ব্রিফিংয়ে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের জানান, তারা প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেছে। এখন সনদের আইনি ভিত্তি ও বাস্তবায়ন এবং নির্বাচনের আগে যে সংস্কারগুলো জরুরি তা সম্পন্ন করার জন্য গণভোট প্রয়োজন। জাতীয় নির্বাচনের গণভোটের দাবি জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপিরও। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক শেষে দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, গণভোটের আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের কোনো সুযোগ নেই, কারণ বিষয়টি জুলাই সনদে অন্তর্ভুক্ত এবং তা গণভোটের পরেই নির্ধারিত হবে। গণভোট ইস্যুতে বিএনপির অবস্থান ভিন্ন। তারা জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের প্রশ্নে জনগণের মতামত নেওয়ার জন্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনই গণভোট আয়োজনের পক্ষে। দলটি মনে করে, একই দিনে ভোট হলে সময়, ব্যয় ও প্রশাসনিক ঝামেলা কমবে; একই সঙ্গে সনদের বিষয়ে জনগণের রায়ও স্পষ্ট হবে। এ কারণেই ২২ অক্টোবর প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে জামায়াত নেতা আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, গণভোটের বিষয়ে বিএনপি প্যাঁচ লাগিয়ে রেখেছে। গণভোটের অভিজ্ঞতা : বাংলাদেশের আদি অর্থাৎ বাহাত্তরের সংবিধানে গণভোটের বিধান ছিল না। ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমান প্রথম গণভোটের আয়োজন করেন। এজন্য ওই বছরের ২ মে তিনি সামরিক আইন আদেশ জারি করেন - যা সাংবিধানিক বৈধতা পায় ১৯৭৯ সালে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর সময়। ওই সংশোধনীতে সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে গণভোট সম্পর্কিত (১খ), (১গ) এবং (১ঘ) বিধান যুক্ত করা হয়। ১৯৯১ সালে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী গৃহীত হয়, যার মাধ্যমে ১৪২ অনুচ্ছেদের (১ক) সংশোধন করে ৫৮, ৮০ ও ৯০ক অনুচ্ছেদ সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোটের বিধান বাতিল করা হয়। অর্থাৎ দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আরও সীমিত আকারে সংবিধানের প্রস্তাবনা, অনুচ্ছেদ ৮, ৪৮ বা ৫৬ সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোট অনুষ্ঠান বাধ্যতামূলক করা হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১১ সালের ৩০ জুন তারিখে জাতীয় সংসদে পাস হওয়া পঞ্চদশ সংশোধনীতে ১৪২ অনুচ্ছেদ প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে গণভোটের বিধান পুরোপুরি বাতিল করা হয়। তবে গত বছরের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগের পতনের পরে গত ১৭ ডিসেম্বর সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী মামলায় ১৪২ ধারা বাতিল ঘোষণা করে আদালত গণভোটের বিধান ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। যদিও আদালতের রায়ে গণভোটের বিধানটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুনর্বহাল হবে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কেননা, জেনারেল ক্লজ অ্যাক্ট ১৮৯৭-এর ৬ ধারা অনুযায়ী কোনো আইনকে পুনরুজ্জীবিত করতে হলে সংসদে বিলটি পাস করাতে হয়। (নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন, ফেব্রুয়ারি ২০২৫)। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত তিনটি গণভোট হয়েছে। ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমানের আমলে। ১৯৮৫ সালের এরশাদের আমলে এবং সবশেষ ১৯৯১ সালে। প্রথম গণভোট হয় ১৯৭৭ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের অনুসৃত নীতি ও কর্মপন্থার প্রতি মানুষের আস্থা আছে কি না - এই প্রশ্নে। মূলত নিজের পদকে বৈধ করার জন্য জিয়াউর রহমান এই গণভোটের আয়োজন করেন। অফিসিয়ালি এই হ্যাঁ না বা গণভোটে অংশ নেন ৩ কোটি ৮৩ লাখ ৬৩ হাজার ৮৫৮ জন ভোটার। এরমধ্যে হ্যাঁ ভোট পড়ে ৩ কোটি ৩৪ লাখ ৮৭০টি। তার মানে প্রদত্ত ভোটের ৯৮.৮৮ শতাংই জিয়াউর রহমানের আস্থা রাখেন। বাকি ৩ লাখ ৭৮ হাজার ৮৯৮টি ভোট পড়ে ‘না’ বাক্সে। জিয়াউর রহমান ওই সময়ে যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিলেন এ কথা সত্য। কিন্তু ৯৯ শতাংশ ভোট পাওয়ার মতো জনপ্রিয় ছিলেন কি না, সেটি প্রশ্নসাপেক্ষ। দ্বিতীয় গণভোট হয় ১৯৮৫ সালের ২১ মার্চ রাষ্ট্রপতি লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের অনুসৃত নীতি ও কর্মসূচির প্রতি আস্থা এবং স্থগিত সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হওয়া পর্যন্ত তার রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত থাকায় জনগণের সম্মতি আছে কি না - এই প্রশ্নে। এরশাদও নিজের ক্ষমতার বৈধতা দেওয়ার জন্য এই গণভোটের আয়োজন করেন এবং স্বভাবতই ভোটের ফলাফল তার পক্ষেই যায়। সরকারি হিসাবে এই গণভোটে ভোট পড়ে ৪ কোটি ৭৯ লাখ ১০ হাজার ৯৬৪টি। এর মধ্যে ৩ কোটি ২৬ লাখ ৬১ হাজার ২৩৩ অর্থাৎ ৯৪.১১ শতাংশ ভোটার এরশাদের পক্ষে ভোট দেন। বাকি ৫.৫০ শতাংশ ভোট পড়ে ‘না’ বাক্সে। গবেষকরা বলছেন, গণভোটের দিন নির্বাচন কেন্দ্রগুলো ছিল শূন্য। জনগণের উপস্থিতি একেবারেই ছিল না। কিন্তু ভোটের বাক্স ব্যালটে ভরে যায়। ভোটের ফলাফল প্রকাশের পরে এরশাদ স্বগর্বে ঘোষণা করেন, জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনের ম্যান্ডেট দিয়েছে। (শিরীন মজিদ, শেখ মুজিব থেকে খালেদা জিয়া, কাকলী প্রকাশনী/১৯৯৩, পৃ. ১৪৪)। বাংলাদেশের ইতিহাসে তৃতীয় তথা সবশেষ গণভোট হয় ১৯৯১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী বিল, ১৯৯১-এ রাষ্ট্রপতির সম্মতি দেওয়া উচিত কি না - এই প্রশ্নে। প্রথম দুটি গণভোটের সঙ্গে তৃতীয় গণভোটের মৌলিক পার্থক্য ছিল এই যে, এই ভোট রাষ্ট্রপ্রধানের ক্ষমতায় টিকে থাকার বৈধতার জন্য নয়, বরং এই গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থা থেকে সংসদীয় ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার জন্য। সরকারি হিসাবে এই ভোটে ৬ কোটি ২২ লাখ ৪ হাজার ১১৮টি ভোট পড়ে হ্যাঁ বাক্সে - যা প্রদত্ত ভোটের ৮৪.৩৮ শতাংশ। যদিও বেসরকারি হিসাবে বা গবেষকদের লেখায় এই ভোটের সংখ্যা আরও অনেক কম। বস্তুত অতীতের তিনটি গণভোটের ফলাফলই নিরঙ্কুশভাবে সরকারের পক্ষে গেছে। বলা হয়, সরকার যে ফলাফল চেয়েছে, গণভোটের ফলাফলে তার কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। এমনকি ভোটের ফলাফলের চিত্রই বলে দেয় এই গণভোটগুলো আসলে কেমন হয়েছে এবং এসব ভোটে সরকারের নিয়ন্ত্রণ কতটা ছিল। এই ধরনের ভোটের ব্যাপারে নানা কারণেই মানুষের আগ্রহ থাকে না। প্রথমত, এই ভোটে তারা তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করেন না। কোনো প্রার্থীর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় না। ফলে মানুষকে ভোটকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করার লোক থাকে না। সরকারও এই ধরনের ভোটে বিপুলসংখ্যক মানুষ উপস্থিত হবে, সেটি প্রত্যাশা করে না। তারা একটি নিয়মরক্ষার আয়োজন করে - যাতে গৃহীত উদ্যোগ বা পদক্ষেপগুলো ভবিষ্যতে আইনি ও সাংবিধানিক প্রশ্নের মুখে না পড়ে। এটা একধরনের গা বাঁচানো তরিকা। বাংলাদেশের বাস্তবতায় গণভোটকে ‘একটা বিচিত্র ধরনের নির্বাচন’ হিসেবে আখ্যায়িত করে খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরী আত্মজীবনীতে লিখেছেন: এখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় দুটি কালো বাক্সের মধ্যে। একটি কালো বাক্সে ‘হ্যাঁ’ লেখা। আরেকটিতে ‘না’। অর্থাৎ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় দুই বাক্সের মধ্যে। এই ‘হ্যাঁ’-‘না’ ভোটের নির্বাচনের গোড়াপত্তনকারী পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইউব খান। সরকারি কর্মচারীরাই এই ভোটগ্রহণের দায়িত্বে থাকেন। তাই ক্ষমতাসীনের বিরুদ্ধে ‘না’ ভোট পড়ার প্রশ্নই ওঠে না। (মিজানুর রহমান চৌধুরী, রাজনীতির তিনকাল, অনন্যা/২০০৩, পৃ. ১৮২)। জুলাই সনদে গণভোট কি যৌক্তিক? : প্রশ্ন হলো, জুলাই সনদের ওপর গণভোট কতটা বাস্তবসম্মত? যে সনদের ওপর গণভোট হবে, সে সম্পর্কে সাধারণ মানুষ কতটা জানে? ৮৪টি প্রস্তাব এবং ৭টি অঙ্গীকারসম্বলিত এই সনদের ওপর সাধারণ মানুষ কী করে ভোট দেবে? ভোটের পদ্ধতি কী হবে? বলা হচ্ছে, জুলাই সনদে যে ৮৪টি প্রস্তাব রয়েছে, সেগুলো গণভোটে যাবে না। বরং ব্যালটে উল্লেখ থাকবে, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন হবে কিনা? সেক্ষেত্রে ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’ - এই সিদ্ধান্তে জনগণ তাদের রায় দেবে। প্রশ্ন হলো, জনগণ কীসের ভিত্তিতে হ্যাঁ না বলবে? শুধু একটি প্রশ্নের ওপর হ্যাঁ না ভোট দিলে আদৌ গ্রহণযোগ্য ও যৌক্তিক হবে? তাছাড়া বাংলাদেশে বিগত তিনটি গণভোটের যে অভিজ্ঞতা, এবারের গণভোটেও যদি একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে, তাহলে এই গণভোটও প্রশ্নবিদ্ধ হবে এবং তার মধ্য দিয়ে মূলত বিতর্কিত হবে জুলাই সনদই। জুলাই সনদের মতো একটি বড় ডকুমেন্ট বা রাজনৈতিক দলিল - যার সবগুলো ধারা ও অঙ্গীকারে রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়ে ওঠেনি; অনেক প্রস্তাবেই বিএনপিসহ আরও একাধিক দল নোট অব ডিসেন্ট বা আপত্তি দিয়েছে। সুতরাং যে দলিলের অনেকগুলো প্রস্তাবেই নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে, তারওপর সাধারণ মানুষ ভোট দেবে কী করে, সেই প্রশ্নের সুরাহা করাও জরুরি। লেখক : সাংবাদিক ও লেখক।

নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha

কমেন্ট বক্স